(১)
বাংলাদেশে মার্ক্সবাদের নানারকম চর্চা হয়েছে। তবে প্রায় সবই হয়েছে পার্টি কেন্দ্রিক। যারা মার্ক্সবাদকে চর্চা করেছেন, তাদের সঙ্গে কোনো-না-কোনো পার্টির যোগসূত্র ছিলই। এভাবে মার্ক্স আর মার্ক্সবাদকে পার্টির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে এর ব্যাপকতাকে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। অ্যাকাডেমিয়ার মধ্যেও যে মার্ক্স-চর্চার প্রয়োজন আছে, সেটা আমাদের পার্টিজানরা ভুলে যান। তারা মনে করেন, পার্টির বাইরে গিয়ে মার্ক্স-চর্চার সুযোগ নেই। কিন্তু পার্টি বলতে তারা কী বোঝান সেটা খোদ মার্ক্সবাদেই স্পষ্ট না। মার্ক্সবাদের পরিধি এতই ব্যাপক যে, স্বভাবতই একে পার্টির অতিক্ষুদ্র সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে আটকানো যায় না এবং উচিতও না। মার্ক্সবাদ কেবল মার্ক্স-লেনিন-মাওয়ের বিপ্লবী পার্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, গ্রামসি-মিলিব্যান্ড-আলথুসেরের তত্ত্বগত চর্চাও মার্ক্সবাদই ছিল। এ কথা সত্য যে, গ্রামসি-মিলিব্যান্ড-আলথুসেরও পার্টিজানই ছিলেন, কিন্তু তাঁদের তাত্ত্বিক চর্চাটা কি তাঁদের পার্টিজানশিপ ছাপিয়ে মহৎ হয়ে ওঠেনি? আমাদের পার্টিজানরা অ্যাকাডেমিয়ার জায়গায় মার্ক্সের চর্চা দেখলে যেভাবে তেড়েমেরে আসেন, মার্ক্সকে নিজেদের পার্টির একচ্ছত্র সম্পত্তি মনে করেন! এই আভিজাত্যপূর্ণ মার্ক্সাড়ম্বর মার্ক্সকেই লজ্জায় ফেলে দিত। পার্টির বাইরে গিয়েও মার্ক্সবাদকে জানা ও বোঝার সুযোগ আছে, দরকারও আছে। সেই প্রয়াসটাই আপনারা দেখবেন এই লেখায়। মার্ক্সীয় দর্শন নিয়ে আমার বোঝাপড়া এই লেখায় বিধৃত হবে।
মার্ক্সবাদ বললেই আমাদের চোখেমুখে ভেসে ওঠে মার্ক্সের ছবি, ক্ষেত্রবিশেষে এঙ্গেলসের ছবিও। মনে হয়, মার্ক্সবাদ যেন মার্ক্সেরই চিন্তাধারা। কথা সত্য, তবে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন আছে। মার্ক্সের চিন্তাধারা হলেও মার্ক্সবাদ হুট করে মার্ক্সের মাথায় চলে আসেনি। এর পেছনে মানবজাতির দীর্ঘ একটা পথচলা আছে। মানুষের চিন্তা হলো বয়ে-চলা একটা নদীর মতো। অনন্তকাল ধরে এই নদী ছুটে চলেছে কীসের দিকে তা সে নিজেও জানে না। সে চলার পথে বহু তৃষ্ণার্তের পিপাসা মিটিয়ে চলে। এই নদীরই একটা ধারায় তৃষ্ণা মেটান কার্ল মার্ক্স। সে ধারাটা আবার রাতারাতি ওদিকে বাঁক নেয়নি। তার পেছনের স্রোতটাও অনেক লম্বা।
মার্ক্সবাদের তিনটা অঙ্গ— অর্থনীতি, রাজনীতি আর দর্শন। এই তিনটা অঙ্গ গড়ে উঠেছে যথাক্রমে ব্রিটিশ অর্থনীতি, ফরাসী সমাজতন্ত্র আর জার্মান ভাবাদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। মার্ক্সবাদকে বুঝতে হলে এর এই উৎসগুলো জানতে হবে।
ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন সমাজ-কাঠামোর মধ্যে অর্থনীতির একটা নতুন যাত্রা শুরু হলো অ্যাডাম স্মিথ আর ডেভিড রিকার্ডোর মতো জাদরেল অর্থনীতিবিদদের হাত ধরে। তারা শ্রমের নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। পরে মার্ক্স তাঁদের কাজকে একটু এগিয়ে নিয়ে গেলেন, কেননা সময়ের বিবেচনায় তিনি এগিয়েই ছিলেন। স্মিথ আর রিকার্ডো সেই সময়ের লোক, যখন পুঁজিবাদ তার উন্মেষ দেখছে কেবল। তাঁরা সেই সময়ে পুঁজিবাদকে ততটুকুই ব্যাখ্যা করেছিলেন, যতটুকু ব্যাখ্যা করা তখন সর্বোচ্চ সম্ভব ছিল। কিন্তু মার্ক্সের সময়ে পুঁজিবাদ অনেক এগিয়ে যায়, বলতে গেলে বিকাশ তখন তার উত্তুঙ্গ। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মার্ক্স পুঁজিবাদকে যেভাবে ব্যাখ্যা করলেন, তা-ও তাঁর সময় অনুযায়ী সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা। তাঁর ব্যাখ্যা স্মিথ-রিকার্ডোকে এই কারণেই ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং মনে রাখা দরকার, মার্ক্সের অর্থনীতি-চিন্তার ভিত্তি ছিল স্মিথ-রিকার্ডো। তাঁদেরই চিন্তাকে তিনি নয়া জামানার চাহিদা অনুযায়ী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও পরিমার্জন করেছেন— যাকে ঠিক চেঞ্জ বলে না, বলে ডেভেলপমেন্ট। এজন্য মার্ক্সীয় অর্থনীতি পড়তে গেলে স্মিথ-রিকার্ডোকে বাদ দিয়ে সম্ভব না। মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ পড়ার আগে অন্তত একবার করে স্মিথের ‘ওয়েলথ অব ন্যাশনস’ আর রিকার্ডোর ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’ পড়ে নেওয়া অবশ্যকর্তব্য। মার্ক্সীয় অর্থনীতি আমার এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। তাই বিস্তারিত বললাম না।
অনেকে মনে করে, মার্ক্স মানেই সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র মানেই মার্ক্স। প্রথম ভাবনাটা যে ভুল, তা আমরা ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছি এই তথ্যের মাধ্যমে যে, রাজনীতির বাইরেও মার্ক্সের অর্থনীতি আর দর্শনে কাজ আছে। তাই মার্ক্সকে কেবল সমাজতন্ত্রের চৌহদ্দিতে আটকানো যায় না। দ্বিতীয় ভাবনাটা ভুল এই কারণে যে, মার্ক্সের আগেও সমাজতন্ত্রের ধারণা ছিল। বৈষম্যহীন সমাজের ধারণা পৃথিবীতে নতুন নয়। অনেক পিছে ফিরে গেলে প্লেটোর রচনায় আমরা আদর্শ রাষ্ট্রের কথা পাব। মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান দার্শনিকদের লেখায় পাব ঈশ্বরের রাজ্যের কথা, যার উৎস মূলত বাইবেলের স্বর্গরাজ্য। এসব হলো সমাজতন্ত্রের আদি নিদর্শন। এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যেও সমাজতান্ত্রিক ভাবনা সেই সাহাবিদের যুগ থেকেই ছিল, যাকে বলা যায় ইসলামী সমাজতন্ত্র। সাহাবি আবু জার গিফারিকে এই চিন্তাধারার প্রথম দার্শনিক আখ্যায়িত করা হয়।
সমাজতন্ত্রের সার্বজনীন চিন্তাটা উঠে আসে ফরাসী বিপ্লবের পরে। ফ্রান্সে সংঘটিত এই মহান বুর্জোয়া বিপ্পব সামন্তবাদের নিপীড়ন থেকে কৃষকদের মুক্তি দিল। অনেকেই আশার আলো দেখল এই বিপ্লবে। কিন্তু কেউ কেউ দেখল বুর্জোয়া শাসনের অন্ধকারাচ্ছন্ন কদর্য রূপটা। ক্যাবে, সাঁ-সিমোঁ, ফুরিয়ে— এরকম কিছু মনীষী বুর্জোয়া শাসন-শোষণের খোলনলচে খুলে মানুষকে দেখাতে লাগলেন, আর জিজ্ঞেস করলেন, ”বলো, এই স্বাধীনতাই কি আমরা চেয়েছিলাম?” স্বাধীনতার জন্যে তাঁদের হাহাকার সত্য ছিল। বুর্জোয়া শাসনের সমস্যা তাঁরা সঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন। রাষ্ট্র আসলে সম্পদশালীদের একটা সংগঠন— রুশোর এই উপলব্ধি মার্ক্সীয় উপলব্ধিতেই পরিণত হয়। এবং আমরা পরে দেখব যে, রুশো যে প্রকৃতির দিকে ফিরে যেতে বলেছিলেন, সেই প্রকৃতি মার্ক্সীয় লিটারেচারে গিয়ে হয়ে যায় ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজ’। এই সাম্যচিন্তা থেকে জন্ম নিল সমাজতন্ত্রের ইউটোপীয় (কাল্পনিক) ধারণা। টমাস ম্যুর ‘ইউটোপিয়া’ নামে একটা বই লিখে একটা বৈষম্যহীন সমাজের চিত্র তুলে ধরলেন। এই মনীষীরা ভেবেছিলেন, মানুষকে শোষণমুক্তির কথা বলেকয়ে বোঝালেই বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁদের সহজসরল মন বোঝেনি, সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি অন্য জায়গায়। সেই চাবিকাঠি পরে আবিষ্কার করলেন মার্ক্স। মার্ক্স প্রতিষ্ঠা করলেন সমাজতন্ত্রের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। কীভাবে একটা সমাজ ভেঙে আরেকটা গড়ে ওঠে সেই সূত্র তিনি আনলেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন রাষ্ট্রযন্ত্রের খুঁটিনাটি— কীভাবে এই রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কীভাবে এর বিকাশ, কীভাবে চলে এর ভাঙাগড়া, কী কী কাজ করে এই যন্ত্রটা ইত্যাদি। তারপর মানবজাতির সামনে প্রকাশ করলেন তাঁর সেই মহান সাম্যবাদের ইশতেহার— দুনিয়ার মজদুর এক হও। এভাবে ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র একটা বৈজ্ঞানিক রূপ পায় মার্ক্সের হাতে, যা পরে মার্ক্সীয় রাজনীতি হিশেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
এবারে আসা যাক মার্ক্সীয় দর্শনের প্রসঙ্গে। মার্ক্সের দার্শনিক চিন্তাধারা কিন্তু গড়ে উঠেছিল স্বদেশের অর্থাৎ জার্মানির আলো-বাতাসেই। অবশ্য তাঁকে জাতিরাষ্ট্রের কাঁটাতারে বন্দী করে ফেলা আমার এই লেখা দেখলে তিনি নিজেই অপছন্দ করতেন। তারপরও যে কথাটা না-বললেই নয়, এই লোকটা নিজের সারাজীবন ব্যয় করেছেন শোষণহীন বৈষম্যহীন একটা পৃথিবী গড়ার কাজে, যে পৃথিবীতে কোনো কাঁটাতার থাকবে না। শোষকদের হাত থেকে বাঁচতে তাঁকেও বারবার এদেশ-ওদেশ পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। মৃত্যুকালে তাঁর আসলে কোনো দেশ ছিল না, তখন তিনি ছিলেন রিফিউজি। এত কিছুর পরেও তাঁর দর্শন আস্থা-ভরসার স্থান হিশেবে বেছে নিয়েছিল স্বদেশের ভাবাদর্শকেই।
সে সময় জার্মানিতে হেগেলের প্রবল প্রতাপ। ফ্রিদরিখ ভিলহেলম হেগেল। তাঁর মতো প্রতাপশালী দার্শনিক কমই জন্মেছেন। এমনকি মৃত্যুর পরেও তাঁর প্রতাপ কমে না। তাঁর অন্তর্ধান হলে তাঁর শিষ্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক দল ‘গুরুবাক্য শিরোধার্য’ মনে করে গুরুর সমালোচনার ধারেকাছেও ঘেঁষত না। এদের হেগেলের ডানপন্থী শিষ্য হলা হতো। আরেক দল ছিল বিপ্লবী। গুরুকে ভক্তিশ্রদ্ধা কম করত না, তবে প্রয়োজনীয় সমালোচনাও করত। এদের বলা হতো হেগেলের বামপন্থী শিষ্য। মার্ক্স, বোঝাই যাচ্ছে, কোন দলের লোক ছিলেন। হেগেলের দর্শন ছিল দ্বান্দ্বিক ভাববাদ। মার্ক্স এই দর্শনকে পরিশুদ্ধ করলে দ্বান্দ্বিকতার অংশটুকু নিলেন, ভাববাদকে ফেলে দিলেন। সে সময়ের আরেক মহান দার্শনিক ছিলেন ফয়েরবাখ। তিনি ছিলেন বস্তুবাদী। মার্ক্স তাঁর বস্তুবাদ কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করেন ফয়েরবাখের কাছ থেকে। এভাবে হেগেলের দ্বান্দ্বিকতা আর ফয়েরবাখের বস্তুবাদ থেকে মার্ক্সীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ জন্ম নেয়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদই হলো মার্ক্সীয় দর্শন।
মার্ক্সবাদের অঙ্গোৎসের এই ছিল সংক্ষিপ্ত আলোচনা। তবে মনে রাখা দরকার, মার্ক্সবাদ কেবল রাজনীতি, অর্থনীতি আর দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মার্ক্সবাদ একটা সামগ্রিক চিন্তাকাঠামো, যা সমাজের প্রতিটা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে চায়। শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি সামাজিক বিজ্ঞান তো বটেই, মার্ক্সবাদের বিচরণ প্রাকৃত বিজ্ঞানেও পরিলক্ষিত হয়।
(২)
মার্ক্সীয় দর্শন বুঝতে হলে দ্বান্দ্বিকতা আর বস্তুবাদ বুঝতে হবে। জগতের মূলে ভাব না বস্তু— এটিই দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন। যুগে যুগে মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর ভেবেছে আর দুই দলে বিভক্ত হয়েছে— ভাববাদী আর বস্তুবাদী। এদের মধ্যে আবার ভাববাদী দলটাই ভারী। ভাব আগে না বস্তু আগে সেই জটিল প্রশ্নে পৌঁছানোর আগে ভাব আর বস্তুর সংজ্ঞায়ন দরকার। বলাবাহুল্য, এই শব্দ দুইটার সংজ্ঞায়নই একটা জটিলতার বিষয়। সহজভাবে বললে, ভাব মানে চিন্তাচেতনা আর বস্তু হলো ভাবের বাইরে যে-কোনো কিছু। ভাববাদীরা মনে করে, আগে ভাব, পরে বস্তু। অর্থাৎ ভাব থেকেই বস্তুর উৎপত্তি। কিন্তু সেটা কীভাবে হয় না-হয় এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভাববাদীরা নিজেরাই অনেক দলে বিভক্ত হয়েছে।
একদিকে আছে সেশ্বর ভাববাদী। সেশ্বর মানে ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তারা মনে করে, বস্তুর সংঘটনের মূলে আছে ঈশ্বর, বা কোনো ঐশ্বরিক শক্তি। বিভিন্ন দার্শনিক একে বিভিন্ন নামে অভিহিত করলেও শেষতক তা ঐশ্বর্যেরই ধারণা। যেমন হেগেল বলেছেন এক মহাচৈতন্যের কথা। এই মহাচৈতন্য যে আসলে ঈশ্বরেরই নামান্তর, তা হেগেলের পাঠক মাত্রই বুঝবে। আরেকদিকে আছে নিরীশ্বর ভাববাদী। এরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। কিন্তু বস্তুজগতের উদ্ভব যে কোনো-না-কোনো চৈতন্য থেকে তা তারা বিশ্বাস করে। তবে সে চৈতন্য কোনো ঐশ্বরিক চৈতন্য নয়। যেমন এদের কেউ কেউ মানবতাবাদী। এদের মতে, মানবচৈতন্যই বস্তুর সংঘটনের মূল। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বোঝা সহজ হবে। ধরা যাক রুশ বিপ্লবের কথা। সেশ্বর ভাববাদী মনে করবে, এই বিপ্লব সংঘটনের মূলে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু নিরীশ্বর ভাববাদী মনে করবে, বিপ্পব সংঘটনের মূলে ছিল বলশেভিক পার্টির ব্যক্তিবর্গের চিন্তাচেতনা।
ভাববাদীদের কেউ কেউ মনে করে, বস্তুজগত ব্যক্তিগত ভাবের বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ তারা মনে করে ‘আমার অনুভূতির সামষ্টিক প্রকাশই হলো জগত’। বার্কলি বলতেন, To be is to be perceived— বস্তুর অস্তিত্ব তখনই মূর্ত হয়ে ওঠে যখন ব্যক্তি তাকে অনুভব করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভাববাদীদের আরেক অংশ বলে, জগত প্রকৃতপক্ষে জগদ্বহির্ভূত কোনো বিশ্বচৈতন্যের সৃষ্টি, যা মানবচৈতন্যের উপর নির্ভরশীল নয়। হেগেলকে আমরা এই দলের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।
ভাববাদীদের কেউ কেউ ভাব আর বস্তুর সম্পর্ক নিরূপণ করতে গিয়ে বস্তুর বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। একমাত্র ভাবই সত্য, বস্তু বলে কিছু থাকলে তা ভাবের প্রতিফলন ছাড়া কিছু নয়। প্রতিফলন বিধায় বস্তুর প্রকৃতপক্ষে কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এদের অদ্বৈতবাদী বলে। ভারতীয় দার্শনিক শঙ্করাচার্যের ‘ব্রহ্ম সত্য জগন্মিথ্যা’ বাক্যটা হলো অদ্বৈতবাদী দর্শনের সারকথা। অপরদিকে দ্বৈতবাদীরা বলে, বস্তুরও অস্তিত্ব আছে, তবে অবশ্যই সে অস্তিত্ব ভাবের অধীন। প্লেটো আর ডেকার্টের ভাববাদ এই ক্যাটাগরিতে পড়ে।
ভাববাদের এরকম অসংখ্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রভেদ আছে। যাই হোক, ভাববাদ বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বস্তুবাদও বিকশিত হয়েছে, যদিও ভাববাদের মতো জনপ্রিয় কখনোই ছিল না। বস্তুবাদ বলে যে, আগে বস্তু, পরে ভাব। বস্তু থেকেই ভাবের উৎপত্তি। বস্তুজগত কারো ভাবনাচিন্তার উপর নির্ভর করে না। আমি ‘অনকা’ বললে পাঠকের মস্তিষ্কে ভাবের কোনো প্রতীতি গড়ে উঠবে না। কারণ ‘অনকা’ বলে কোনো বস্তু নাই, থাকলেও পাঠকের জানা নাই। কিন্তু যদি বলি বিড়ালের কথা, তাহলে পাঠকের মস্তিষ্কে বিড়ালের ছবি বা ভাব ভেসে উঠবে। এই ভাবটা গড়ে উঠেছে বস্তু-বিড়ালকে আশ্রয় করেই। যদি বস্তু-বিড়াল না-থাকত, ভাব-বিড়ালও থাকত না। বস্তুবাদীরা যখন বলে, বস্তু ছাড়া ভাব হয় না, তখন তারা এটাই বোঝায়। আবার দেখুন, মানুষের ভাবনাচিন্তায় একসময় স্থির পৃথিবী ছিল, কিন্তু বাস্তবে পৃথিবী ছিল গতিশীল। বস্তুবাদীরা তাই বলে, বস্তুজগত ভাবনাচিন্তার উপর নির্ভর করে না।
বস্তুবাদের একটা আদিরূপ ছিল ডেমোক্রিটাসের পরমাণুবাদ। তিনি মনে করতেন, সবকিছুর মূলে আছে বস্তু— পরমাণু। ভারতে চার্বাকরা ছিল বস্তুবাদী। জগতের সৃষ্টিকর্তা হিশেবে তারা কোনো ঈশ্বর কিংবা দেবতাকে বিশ্বাস করত না। বরং তারা জগতের মূলে বস্তু হিশেবে আগুন, পানি, মাটি, বাতাস এসবকে স্বীকার করত। যেহেতু বস্তুর উপর ভাবের প্রাধান্য বস্তুবাদী দর্শন স্বীকার করে না, তাই বস্তুবাদ মানেই নিরীশ্বর দর্শন।
বস্তুবাদীদের একটা অংশ ভাবকে একদম বাতিল করে দিয়ে এর একটা যান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করে। আমরা তাকে যান্ত্রিক বস্তুবাদ বলি। যান্ত্রিক বস্তুবাদ অনুযায়ী, ভাব বা মানব মনন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে, বস্তুজগতের উপর তার কোনোই প্রভাব নেই। মার্ক্স এই ধরনের বস্তুবাদের সমালোচনা করে ভাবের গুরুত্ব এবং বস্তু-ভাবের পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘থিসেস অন ফয়েরবাখ’ (ফয়েরবাখের উপর এগারোটা থিসিস) খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা। প্রথম থিসিসটায় মার্ক্স বলেন, The chief defect of all hitherto existing materialism— that of Feuerbach included— is that the thing, reality, sensuousness, is conceived only in the form of the object or of contemplation, but not as sensuous human activity, practice, not subjectively। মার্ক্স যেটাকে ‘চিফ ডিফেক্ট’ বলছেন, তা থেকে উত্তরণের ‘রেভ্যুলেশনারি প্র্যাকটিস’ উল্লেখ করেছেন তৃতীয় থিসিসে গিয়ে— The coincidence of the changing of circumstances and of human activity or self-changing can be conceived and rationally understood only as revolutionary practice। এই থিসিসগুলো থেকেই বস্তু-ভাবের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের একটু হেগেলের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। হেগেলের মতে, এক মহাচৈতন্যের বিকাশ থেকে বস্তুজগতের সৃষ্টি। এই বিকাশটা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ তা দ্বান্দ্বিক। পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এই বিকাশ এগিয়ে চলছে। ক্রিয়াকে যদি থিসিস বলি, প্রতিক্রিয়া তাহলে অ্যান্টিথিসিস; আর এদের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া, তা-ই সিন্থিসিস। হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার ভিত্তি থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিন্থিসিস সম্পর্কটা। পরিবেশে দ্বন্দ্ব ছাড়া কিছু নেই। রাত আর দিনের দ্বন্দ্ব আছে, প্রোটন আর ইলেক্ট্রনের দ্বন্দ্ব আছে, শাসক আর শাসিতের দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্বমান দুইটা ভাব বা বস্তুর একটা থিসিস হলে অন্যটা অ্যান্টিথিসিস। আর এদের মিথস্ক্রিয়া থেকে সিন্থিসিস গড়ে ওঠে। যেমন রাত-দিনের সিন্থিসিস হলো সময়, প্রোটন-ইলেক্ট্রনের সিন্থিসিস হলো পরমাণু, শাসক-শাসিতের সিন্থিসিস হলো সমাজব্যবস্থা। এই মিথস্ক্রিয়াই হলো মহাচৈতন্যের বিকাশ। হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতার এই ভাববাদী দিকটা মার্ক্স ফেলে দিলেন। একে নতুনভাবে ঢেলে সাজালেন বস্তুবাদী ভিত্তির উপর। মার্ক্স বললেন, চৈতন্য অস্তিত্বকে নয়, বরং অস্তিত্বই চৈতন্যকে নির্ধারণ করে।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে মনে করা হয়, সকল বস্তু পরস্পরসম্পৃক্ত। স্টালিন যখন বলেন, প্রকৃতি কোনো ‘accidental agglomeration of things’ নয়, তখন তিনি এটাই বোঝাতে চান। এই কারণে থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিন্থিসিসকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বস্তুর গতিশীলতার কথা বলে। অর্থাৎ পুরাতনকে ভেঙে নতুন কিছু গড়ে ওঠাই বস্তুজগতের নীতি। সমাজব্যবস্থাও এক জায়গায় বসে থাকে না, নিরন্তর ছুটে চলে পরিবর্তনের দিকে। প্রকৃতির কোথাও বিরাম নেই, স্থবিরতা নেই। এমনকি পরমাণুর ভিতরে ইলেক্ট্রনগুলোও অস্থির। প্রকৃতির সবকিছুই ভাঙছে আর গড়ছে, গড়ছে আর ভাঙছে। বদলে যাচ্ছে। এই বদলে যাওয়াও আবার বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এর একটা ধারাবাহিকতা আছে। হেগেলের থেকে ধার করে মার্ক্স যেটাকে বললেন Quantitative to Qualitative Change। একটা কাগজ আর একটা খাতার মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে। কিন্তু খাতাটা গড়ে উঠেছে কাগজের পরিমাণ একটা একটা করে যুক্ত হওয়ার পরে। পানির মধ্যে তাপমাত্রার পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করতে থাকলে আকস্মিকভাবে পানি একসময় বাষ্পে পরিণত হয়। পানি আর বাষ্পের গুণগত পার্থক্য অনেক। এইভাবে প্রকৃতির সবকিছুই বদলে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ কী? দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বলে, কারণটা মূলত অভ্যন্তরীণ। বাইরের কোনো প্রভাব থাকলে থাকতে পারে (যেমন পানির ক্ষেত্রে তাপ), কিন্তু সেটা গৌণ। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব গড়ে ওঠে যাকে মার্ক্স বলছেন Unity of Opposites বা বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব, তার মাধ্যমে। যেমন সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব গড়ে ওঠে শাসক ও শাসিতের বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব থেকে। পরিবর্তনের পরবর্তী ধাপ পূর্ববর্তী ধাপকে বাতিল করে দেয়। যেমন বাষ্প বাতিল করে পানিকে। এই নিয়মকে বলা হয় Negation of Negation।
আরেকটি ছোট্ট আলোচনা বাকি থেকে গেল। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব মনে করে, জগতকে জানা সম্ভব। জগতের এই পরিবর্তনগুলোকে আমরা দ্বান্দ্বিকতার সূত্রগুলো দিয়ে বুঝতে পারি। কিন্তু যান্ত্রিক বস্তুবাদ মনে করে, জগতকে জেনে ওঠা অসম্ভব। একটা অজ্ঞেয়বাদী আস্তরণ যান্ত্রিক বস্তুবাদের চোখ ঢেকে রাখে সব সময়।
মার্ক্সবাদের এই তত্ত্বগুলো সমাজের পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে থাকে। সেই ব্যাখ্যাকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ছাড়া দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সে বিষয়েও আমাদের বোঝাপড়া প্রয়োজন।